ডায়বেটিস চেক করুন সঠিক নিয়মেঃ রোগীকে সকালে খালি পেটে একবার রক্তে গ্লুকোজ পরীক্ষা করতে হয়, তারপর ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ শরবত পানের দুই ঘণ্টা পর আরেকবার রক্তে গ্লুকোজ পরীক্ষা করা হয়। এই পদ্ধতিতে নির্ভুলভাবে ডায়াবেটিস ও প্রি-ডায়াবেটিস নির্ণয় করা যায়।
কিন্তু পরীক্ষা করতে অনেকে প্রায়ই ঝামেলার মধ্যে পড়েন। কেননা, কমপক্ষে আট ঘণ্টা না খেয়ে সকালে রক্তের নমুনা দিতে হবে, দুইবার রক্ত দিতে হবে এবং মাঝে দুই ঘণ্টা সময় বিশ্রামে বা ল্যাবে বসে থাকতে হবে। তার ওপর মিষ্টি দ্রবণ অনেকেই পান করতে চান না। বিজ্ঞানীরা তাই আরও সহজ কোনো পদ্ধতি খুঁজছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় তাই ডায়াবেটিস শনাক্তকরণের জন্য এইচবিএ১সি নামের পরীক্ষা করা হয়। এটি রক্তে শর্করার কয়েক মাসের গড় নির্দেশ করে। এই পরীক্ষা দিনের যেকোনো সময় করা যায় এবং রক্তের নমুনা একবারই দিতে হয়।
আমেরিকান ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের গাইডলাইন অনুযায়ী এইচবিএ১সির মান ৫.৭-এর নিচে থাকলে তাকে স্বাভাবিক ধরা যায়। এটি ৬.৫-এর বেশি হলে ডায়াবেটিস আছে বলে ধরা হবে। এই মান ৫.৭ থেকে ৬.৫-এর মধ্যে থাকলে প্রি-ডায়াবেটিস বা ডায়াবেটিসের পূর্বাবস্থা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
তবে এইচবিএ১সি পরীক্ষা ভালো মানের ল্যাবরেটরিতে নির্দেশিত পদ্ধতিতে করতে হবে। কারও বংশগত রক্তরোগ থাকলে বা রক্ত ভেঙে যাওয়ার সমস্যা থাকলে এই পরীক্ষা সঠিক ফল না-ও দিতে পারে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নির্ণয়ে এই পরীক্ষার ব্যবহার করা হয় না।
৪০ বছর বয়সের পর ওজনাধিক্য, ডায়াবেটিসের পারিবারিক ইতিহাস ও অন্যান্য ঝুঁকি থাকলে নিয়মিত ডায়াবেটিস স্ক্রিনিং করা উচিত। এই উদ্দেশ্যে ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট বা এইচবিএ১সি পরীক্ষা করা যেতে পারে।
আরো কিছু নিয়ম জানতে পড়ুন,👇👇
এ ওয়ান সি পরীক্ষা (গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিন): এই পরীক্ষার জন্য খালি পেটে থাকার প্রয়োজন হয় না এবং বিগত তিন মাসে রক্তে শর্করার গড় মাত্রা জানা যায় এই পরীক্ষা থেকে। রক্তের ‘হিমোগ্লোবিন’য়ে কত শতাংশ শর্করা জুড়ে আছে এবং লোহিত রক্তকণিকায় অক্সিজেনবাহী প্রোটিন কী মাত্রায় আছে তা নির্ণয় করে পরীক্ষাটি।
রক্তে শর্করা যত বেশি হবে, ‘হিমোগ্লোবিন’য়ের সঙ্গে ততই বেশি মাত্রায় শর্করা জুড়ে থাকবে। সাধারণত, ‘এওয়ানসি’র মাত্রা যদি পরপর দুই পরীক্ষায় ৬.৫ বা তারও বেশি থাকে তাহলে বুঝতে হবে আপনার ডায়াবেটিস হয়েছে। ‘এওয়ানসি’য়ের মাত্রা ৫.৭ থেকে ৬.৬ এর মধ্যে থাকে তবে আপনি ‘প্রিডায়াবেটিক’ আর ৫.৭ এর নিচে হলে তা স্বাভাবিক।
তবে আপনি যদি গর্ভবতী হন কিংবা আপনার ‘হিমোগ্লোবিন’য়ের ধরন যদি ভিন্ন হয়, যাকে বলা হয় ‘হিমোগ্লোবিন ভ্যারিয়েন্ট’, তাহলে এই পরীক্ষার ফল ভুল আসতে পারে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসক আপনাকে আরও কিছু পরীক্ষা করাতে বলবেন।
র্যান্ডম ব্লাড সুগার: নাম থেকেই বোঝা যায় যে এই পরীক্ষায় রক্তের নমুনা নেওয়া হবে ‘র্যান্ডম’ অর্থাৎ বিভিন্ন সময়ে, খালি পেট কিংবা ভরা পেট দুটোই হতে পারে। ‘র্যান্ডম ব্লাড সুগার’য়ের মাত্রা ২০০ এমজি/ডিএল হলে ডায়াবেটিস বেশি।
ফাস্টিং প্লাজমা গ্লুকোজ (এফপিজি) পরীক্ষা: এই পরীক্ষা খালি পেটে করতে হয়, যার কারণে অনেকেই দ্বিধায় পড়ে যান যে কীভাবে এটি করতে হবে। সঠিক উপায় হল সারারাত বা আট থেকে ১২ ঘণ্টা না খেয়ে থাকার পর এই পরীক্ষা করাতে হবে। ১০০ এমজি/ডিএল হল স্বাভাবিক ফলাফল। ১০০ থেকে ১২৫ এমজি/ডিএল হল ‘প্রিডায়াবেটিক’ এবং ১২৬ এমজি/ডিএল মানে হল আপনার ডায়াবেটিস হয়ে গেছে।
পোস্টপ্রান্ডিয়াল গ্লুকোজ: সকালের নাস্তা খাওয়ার দুই ঘণ্টা পরে এই পরীক্ষার জন্য রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হবে। তবে সকালের নাস্তায় মানুষ বিভিন্ন ধরনের খাবার খায়, অনেকে আবার পরীক্ষার ফল স্বাভাবিক আসবে এমন খাবার বেছে নিয়ে খান। তাই সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য সকালের নাস্তায় ৭৫ গ্রাম শর্করা খাওয়া পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। শরীর শর্করাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে সেটা দেখাই এই পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য।
ফলাফল ১৪০ এমজি/ডিএল এর বেশি হলে তা অস্বাভাবিক। নিজের ইচ্ছে মতো সকালের নাস্তা খেলে এমন খাবার খান যা আপনি প্রায় প্রতিদিনই খান, কোনো পরিবর্তন আনবেন না।
ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স: এই পরীক্ষা করা হয় দুই ধাপে। প্রথম ধাপে সারারাত না খেয়ে থাকার পর সকালে প্রথম রক্তের নমুনা নেওয়া হবে ‘ফাস্টিং ব্লাড সুগার’ পরিমাপের জন্য। এরপর চিনিযুক্ত পানীয় খাওয়ানো হবে এবং দুই ঘণ্টা পর আবার রক্তের নমুনা নিয়ে রক্তে শর্করার মাত্রা পরিমাপ করা হবে। পরীক্ষায় ‘টাইপ ওয়ান’ ডায়াবেটিস ধরা পড়লে মূত্র পরীক্ষা করাতে বলতে পারেন চিকিৎসক।
শর্করা ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদনের জন্য শরীরে পর্যাপ্ত ‘ইনসুলিন’ না থাকার কারণে শরীর পেশি ও চর্বি ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করে, আর এই প্রক্রিয়ার কারণে মূত্রের সঙ্গে কোনো উপজাত দ্রব্য আসছে কিনা সেটা জানার জন্যই মূত্র পরীক্ষা করা হয়।
জেস্টেইশনাল ডায়াবেটিস: গর্ভাবস্থার প্রাথমিক পর্যায়ে যাদের ওজন বেশি থাকে তাদের ‘জেস্টেইশনাল ডায়াবেটিস’ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এর আগে গর্ভধারণের সময় ‘জেস্টেইশনাল ডায়াবেটিস’ থাকলে কিংবা মা, বাবা, ভাইবোন বা সন্তানের এই ডায়াবেটিস থাকলেও ঝুঁকি বাড়ে। গর্ভাবস্থায় প্রথম দিকেই চিকিৎসক পরীক্ষা করাতে বলবেন।
এই পরীক্ষায় প্রথমে রোগীকে ‘সিরাপ’য়ের মতো একটি গ্লুকোজের দ্রবণ পান করানো হয়। তার এক ঘণ্টা পর পরীক্ষা করা হবে রক্তে শর্করার মাত্রা। এই পরীক্ষায় শর্করার মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হবে ‘ফলো-আপ’ পরীক্ষার মাধ্যমে ‘জেস্টেইশনাল ডায়াবেটিস’ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
এই ‘ফলো-আপ’ পরীক্ষাকে বলা হয় ‘ফলো-আপ গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট’। এখানে সারারাত না খেয়ে থাকার পর রক্তে শর্করার মাত্রা পরিমাপ করতে বলা হবে। এরপর মিষ্টি দ্রবণ পান করতে বলা হবে যাতে প্রচুর পরিমাণে শর্করা থাকবে। তারপর পরবর্তি তিন ঘণ্টায় এক ঘণ্টার বিরতিতে তিনবার রক্তে শর্করার মাত্রা পরিমাপ করা হবে। যদি দুটি ফলাফল স্বাভাবিকের চাইতে বেশি আসে তবে আপনার ‘জেস্টেইশনাল ডায়াবেটিস’ আছে।
ঘরে পরীক্ষা
এজন্য প্রয়োজন হবে ‘গ্লুকোমিটার’ নামক একটি যন্ত্র। এই যন্ত্রের সাহায্যে সঠিক ফলাফল পেতে নিচের পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করতে হবে।
- হাত ভালোভাবে ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হবে।
- যন্ত্রে ‘টেস্ট স্ট্রিপ’ প্রবেশ করাতে হবে।
- আঙ্গুলের ডগায় ‘টেস্ট কিট’য়ের সুঁই দিয়ে ফুটো করতে হবে।
- এবার আঙ্গুলে সামান্য চাপ দিয়ে এক ফোঁটা রক্ত ‘টেস্ট স্ট্রিপ’য়ের উপর ফেলতে হবে।
- আঙ্গুলে থাকা রক্তে ‘টেস্ট স্ট্রিপ’টি স্পর্শ করালেও কাজ হবে। কয়েক সেকেন্ড পরেই যন্ত্রটি ফলাফল দেখাবে।
0 Comments