হিমোগ্লোবিন কি?
হিমোগ্লোবিন অক্সিজেনের সাথে কার্বণ ডাই অক্সাইড বিনিময় করে। অর্থাৎ ফুসফুস থেকে অক্সিজেন নিয়ে শরীরে পাঠায় আর শরীর থেকে বিষাক্ত কার্বণ ডাই অক্সাইড নিয়ে ফুসফুসে পাঠিয়ে দেয়। অতপর ফুসফুস সেটাকে আমাদের নিশ্বাস ফেলার মাধ্যমে বাইরে পাঠিয়ে দেয়।
হিমোগ্লোবিন আমাদের শরীরের একটি প্রয়োজনীয় প্রোটিন, মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় একে মেটালোপ্রোটিনও বলা হয়ে থাকে। এটি আমাদের রক্তের লোহিত কণিকায় থাকে এবং রক্তের মাঝে প্রয়োজনীয় ঘনত্ব বজায় রাখে। হিমোগ্লোবিনের জন্যে রক্ত যেমন ঘন হয়, তেমনি লালও হয়। রক্তের অন্যান্য উপাদান সচরাচর বর্ণহীন হয়ে থাকে, হিমোগ্লোবিনই রক্তকে লাল করে থাকে।
হিমোগ্লোবিন আমাদের দেহে দুই ধরণের প্রোটিন গঠনে ভূমিকা রাখে বলে জানিয়েছে মেডিকেল সায়েন্স। এর একটি হচ্ছে টারশিয়ারী আর অন্যটি হচ্ছে কোয়াটার্নারী। উভয় ধরণের প্রোটিনই শরীরের জন্যে দরকারি। আর এসব প্রোটিনের স্থায়িত্ব প্রদান করার জন্যে হিমোগ্লোবিন রক্তের মাঝে আলফা হেলিক্স নামের এক ধরণের অ্যামিনো অ্যাসিড উৎপন্ন করে থাকে।
হিমোগ্লোবিনের কাজ কি?
আমরা আগেই জেনেছি হিমোগ্লোবিন বর্ণহীন রক্তকে লাল করে থাকে। সেই সাথে রক্তে থাকা নানা রকম উপাদানের পর্যাপ্ততাও নিশ্চিত করে থাকে। তবে হিমোগ্লোবিনের মূল কাজ শরীরে অক্সিজেন পরিবহণ করা। এটি মানুষের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে যেসব সমস্যা হয় তার মাঝে প্রধাণতম বিষয়টি হচ্ছে অক্সিজেন স্বল্পতা।
আমরা যখন বাতাস থেকে নিশ্বাসের সঙ্গে অক্সিজেন গ্রহণ করি, তখন এটি প্রথমে আমাদের ফুসফুসে যায়। আর ফুসফুস থেকে এই অক্সিজেন শরীরের প্রতিটি টিস্যুতে প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পরিবহণের দায়িত্বটি পালন করে হিমোগ্লোবিন।
সুতরাং, আমরা বুঝতে পারছি যে আমাদের রক্তের অক্সিজেন সরবরাহের সঙ্গে হিমোগ্লোবিনের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই রক্তে যদি কখনো এই লোহিত অনু ধারণকারী পদার্থটি কমে যায়, তবে শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। আর তখন আমরা অ্যানিমিয়াসহ নানা রকম শারীরিক সমস্যার সন্মুখীন হই।
রক্তে কোনও দূষিত পদার্থ দেখা দিলে হিমোগ্লোবিন সেটাকে পরিস্কার করে অর্থাৎ রক্তে যে কোন ধরণের ক্ষতিকর পদার্থ মিশ্রণে বাধা প্রদান করে। এমনকি, আমাদের শরীরে যত ধরণের বিষাক্ত গ্যাস জমা হয়, হিমোগ্লোবিন সেগুলোকে শরীরের বাইরে পরিবহণেও সহযোগীতা করে থাকে।
মানুষের দেহের রক্ত কণিকার ৯৬ থেকে ৯৭ ভাগই হয়ে থাকে হিমোগ্লোবিনের প্রোটিন অংশ। আর রক্তের মোট ওজনের (পানিসহ) ৩৫ ভাগই দখল করে থাকে এই হিমোগ্লোবিন। আমাদের শরীরে থাকা প্রতি ১ গ্রাম হিমোগ্লোবিন বাতাস থেকে প্রতিবার ১.৩৬ মিলিলিটার, কখনো কখনো তার চেয়ে কিছুটা বেশি অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে। যারফলে, শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ বিশেষ করে রক্তে এর পরিবহণের মাত্রা প্রায় ৭০ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
আমাদের শরীরের ৯৭ ভাগ অক্সিজেন ফুসফুস থেকে হিমোগ্লোবিনের মাধ্যমে শরীরের নানা অংশে সরবরাহ হয়ে থাকে। যে ৩ ভাগ বাকী থাকে, তা রক্তের প্লাজমায় মিশে যায়। হিমোগ্লোবিন রক্তের মধ্যে কমপক্ষে ৩০ থেকে ঊর্ধ্বে ১০০ বার পর্যন্ত অক্সিজেন মুভ করাতে পারে।
ফুসফুসের যেখানে অক্সিজেনের লেবেল অত্যন্ত বেশি থাকে, হিমোগ্লোবিন খুব সুন্দরভাবে সেখানে অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক করে দেয়। অর্থাৎ যে স্থানে অক্সিজেন বেশি সেখান থেকে বাড়তি অক্সিজেন নিয়ে যেখানে কম সেখানে পৌঁছে দেয়। হিমোগ্লোবিনের প্রতিটি অনুর ৪টি আয়রণ পরমাণু থাকে। আর প্রতিটি আয়রণ পরমাণু একটি করে অক্সিজেন গ্রহণ করে।
মানব শরীরে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কত থাকা প্রয়োজন ?
প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের 100 ml বা ডেসিলিটার (দল) রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ 13-16 g।
পুরুষের 14-18 g/dl
স্ত্রীলোকের 12-15 g/dl
নবজাতকে 23 g/dl
রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে কি হয়
এবার হিমোগ্লোবিনের অভাবে কি হয় সে সম্পর্কে আমরা আমাদের ধারণাকে পরিস্কার করে নেবো।
হিমোগ্লোবিনের অভাবে নিঃশ্বাসে সমস্যা হয়
আমরা আগেই জেনেছি যে আমাদের শরীরে অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের গুরু দায়িত্বটি পালন করে হিমোগ্লোবিন। এটি ফুসফুস থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করে শরীরের সব স্থানে পরিমাণ মতো পৌঁছে দেয়। সুতরাং, বুঝতেই পারছেন যদি রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যায় তবে শরীরে সর্বত্র অক্সিজেন সরবরাহ বাধাগ্রস্ত অর্থাৎ প্রয়োজনীয় সংখ্যক হিমোগ্লোবিন না থাকার কারণে শরীরের কিছু কিছু অংশে অক্সিজেন পৌঁছে না। ফলে, নিঃশ্বাসে দূর্বলতা দেখা দেয়। অর্থাৎ, স্বাভাবিক নিঃশ্বাস বাধাগ্রস্ত হয়। আর কখনো কখনো দেখা যায় নিশ্বাস নিতে অস্বাভাবিক কষ্ট হয়।
হিমোগ্লোবিনের অভাবে শারীরিক দূর্বলতা দেখা দেয়
হিমোগ্লোবিন কম থাকা মানে শরীরে রক্ত কম থাকা এবং রক্তের ঘনত্বও স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকা। এ রকম অবস্থায় শরীর তার প্রয়োজনীয় ফাংশনালিটি পায় না। ফলে শারীরিক দূর্বলতা দেখা দেয়। দৈনন্দিন কাজ-কর্ম করার জন্যে স্বাভাবিক যে শক্তির প্রয়োজন, তাতে বেশ ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে শরীরের হাড়গুলোতে শক্তির অভাব দেখা দেয়।
হিমোগ্লোবিনের অভাবে মাথা ব্যথা হয় ও মাথা ঘোরে
শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মতো মাথায়ও স্বাভাবিক রক্ত চলাচল প্রয়োজন। সেই সাথে মাথায় প্রবাহিত রক্তে যথেষ্ট পরিমাণে হিমোগ্লোবিনের প্রয়োজন। যদি তা না থাকে, অর্থাৎ পরিমাণ মতো হিমোগ্লোবিনের অভাবে মাথা ব্যথা দেখা দেয়। সেই সাথে মাথা ঘোরে, ঝিম ঝিম করতে থাকে সারাক্ষণ একটা অস্বস্তি লেগে থাকে।
হিমোগ্লোবিনের অভাবে হার্ট বিট বেড়ে যায়
আমরা সকলেই জানি যে হার্ট বা হৃৎপিন্ড আমাদের দেহে রক্ত পরিশোধনের কাজটি করে থাকে। প্রতিদিন একজন মানুষের হার্ট প্রায় ৭০০ গ্যালন রক্ত পরিশোধন করে থাকে। আপনি হয়তো এই ভেবে অবাক হতে পারেন যে, একজন মানুষের শরীরে ৭০০ গ্যালন রক্ত আসবে কোথা থেকে!
আপনার ভাবনা এক অর্থে ঠিক। কিন্তু আপনার জানা প্রয়োজন যে, আমাদের দেহে যে রক্ত প্রবাহ চলতে থাকে, সেগুলো ঘুরে ফিরে হার্টে আসে আর হার্ট সেগুলো পরিশোধন করে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পাঠিয়ে দেয়। হার্টের মাধ্যমে ব্লাডের এই সার্কুলেশন চলতেই থাকে। বুঝতেই পারছেন, আমাদের দেহে যথেষ্টা পরিমাণ বক্ত না থাকলে এবং রক্তে হিমোপ্লিবেনর ঘাটতি দেখা দিলে হার্টের এই ব্লাড সার্কুলেশন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে, আমাদের হার্ট বিট বেড়ে যায় যা মোটেই সুখকর নয়।
হিমোগ্লোবিনের অভাবে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়
হিমোগ্লোবিনের অভাবে অনেক সময়ই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। আমরা সকলেই জানি যে রক্ত সাধারণত গরম হয়ে থাকে। যেমন কোন কারণে আমাদের শরীরে কোথাও কাটা গেলে যে রক্ত বের হয় তা ধরলে হাল্কা গরম অনুভূত হয়। আসলে রক্তের মধ্যে থাকা হিমোগ্লোবিনই আমাদের হাত পা হাল্কা গরম করে রাখে। আর যখনই হাত পা যে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি তৈরি হয়, তখনই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়।
হিমোগ্লোবিনের অভাবে ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যায় ও হলুদ বর্ণ ধারণ করে
হিমোগ্লোবিনের অভাবে হলুদ বর্ণ ধারণ করে আমাদের ত্বক। এ রকম অবস্থায় অর্থাৎ যখন ত্বক হলুদ হয়ে ওঠে, অনেকেই তখন এটাকে জন্ডিস হয়েছে ভেবে ভুল করে থাকে। আসলে ত্বকের স্বাভাবিক রঙের পেছনে রক্তের হিমোগ্লোবিন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আর যখন ত্বকের নিচে যথেষ্ট পরিমাণ হিমোগ্লোবিন প্রবাহিত না হয়, তখন আমাদের শরীরের ত্বক আস্তে আস্তে ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
হিমোগ্লোবিনের অভাবে মনোযোগ বিঘ্নিত হয়
রক্তে যদি যথেষ্ট পরিমাণে শরীরের জন্যে পাওয়ারফুল হিমোগ্লোবিন না থাকে, তবে সেটা আমাদের মনোযোগেও প্রভাব ফেলে। কারণ শরীর ও মনের মাঝে রয়েছে গভীর সংযোগ, সুবিশাল সেতুবন্ধন। শরীরে যখন কোন কিছুর অভাব দেখা দেয়, তখন সেটি মনকেও প্রভাবিত করে।
হিমোগ্লোবিনের বেলায়ও একই রকম হয়ে থাকে। এটির অভাবে শরীরে যেমন নানা রকম সমস্যা তৈরি হয়, তেমনি মনেও দেখা মারত্মক সংকট। তার মাঝে সবচেয়ে বড় সংকটই হচ্ছে মনোযোগে সমস্যা। অর্থাৎ কোন কিছুতে ঠিক মতো মনোযোগ দিতে না পারা।
আমরা জানলাম রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে কি হয়। যেগুলো জানলাম সেগুলোর বাইরেও আরো কিছু ছোট খাট শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। তবে উল্লেখিত সমস্যাগুলোই প্রধান।
রক্তে যাতে যথেষ্ট পরিমাণে হিমোগ্লোবিন উৎপন্ন হয়, সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকার প্রধাণ উপায়ই হচ্ছে এইসব খাবার খাওয়া।
লৌহযুক্ত খাবার
শরীরে লৌহের ঘাটতি হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে লোহা গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। লৌহসমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে রয়েছে মুরগির কলিজা, ঝিনুক, ডিম, আপেল, বেদানা, ডালিম, তরমুজ, কুমড়ার বিচি, খেজুর, জলপাই, কিশমিশ ইত্যাদি।
ভিটামিন সি
ভিটামিন সি-এর অভাবে হিমোগ্লোবিন কমে যেতে পারে। তা ছাড়া ভিটামিন সি ছাড়া লোহা পুরোপুরিভাবে শোষণ হয় না। পেঁপে, কমলা, লেবু, স্ট্রবেরি, গোলমরিচ, সবুজ ফুলকপি (ব্রকোলি), আঙুর, টমেটো ইত্যাদিতে প্রচুর ভিটামিন সি থাকে।
ফলিক অ্যাসিড
ফলিক অ্যাসিড একপ্রকার ভিটামিন বি কমপ্লেক্স। এটি লাল রক্তকণিকা তৈরিতে প্রয়োজনীয় উপাদান। সবুজ পাতাযুক্ত সবজি, কলিজা, ভাত, শিমের বিচি, বাদাম, কলা, সবুজ ফুলকপিতে অনেক ফলিক অ্যাসিড পাওয়া যায়।
বিট
হিমোগ্লোবিন বাড়াতে বিটের রস খাওয়ার পরামর্শ দেন ডাক্তাররা। এতে রয়েছে প্রচুর আয়রন, ফলিক অ্যাসিড, ফাইবার ও পটাশিয়াম। এর পুষ্টিমান শরীরের লাল রক্তকণিকা বাড়ায়।
আপেল
দিনে একটি করে আপেল খেয়ে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখতে পারেন। আয়রনের উৎস আপেলে আরও নানা প্রকার পুষ্টি উপাদান রয়েছে। প্রতিদিন খোসাসহ একটি আপেল খান। অথবা সমানুপাতে আপেল ও বিটের রস মেশাতে পারেন।
ডালিম
আয়রন, ক্যালসিয়াম, শর্করা ও আঁশ (ফাইবার) সমৃদ্ধ ডালিম রক্তে হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধি করে দেহে রক্ত চলাচল সচল রাখে। প্রতিদিন মাঝারি আকৃতির একটি ডালিম খাওয়ার চেষ্টা করুন। অথবা এক গ্লাস ডালিমের জুস খান।
শেষ কথা
হিমোগ্লোবি কি আর এর কাজ সম্পর্কে আমাদের মোটামুটি একটা ভাল ধারণা হয়েছে। এখন আমাদের যে ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন থাকতে হবে, তা হচ্ছে রক্তে যেন হিমোগ্লোবিন কমে না যায়। আর যদিও কোন কারণে কমে যায়, তবে আমাদেরকে নিয়মিত ওইসব খাবার খেতে হবে, যেসব খাবার রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ায়।
0 Comments